Edit Template

গ্রেপ্তার হওয়া শিশু: অধিকার, আদালত ও আশার পথ ( শিশু আইন ২০১৩ )

গ্রেপ্তার হওয়া শিশু

একটি শিশুর গ্রেপ্তারের গল্প— গ্রেফতার এই শব্দ দুটি শুনলেই হয়তো বড় কোনো অপরাধের চিত্র মনে আসে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই চিত্রটা ভিন্ন হয়।এক বিকেলে, ঢাকার এক মহল্লায় , ১৩ বছরের শুভ তার এক বন্ধুর হাতে থাকা পুরনো মোবাইল ফোনটি নিয়ে মজা করছিল। এটা দেখে দোকানদার সন্দেহ করে ফোনটি চুরি করা হয়েছে বলে চেঁচামেচি শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুভকে পুলিশ ভ্যানে উঠানো হয়— মুখে আতঙ্ক, চোখে জল।

শুভর বাবা-মা যখন জানতে পারলেন, তখন শুভ থানায়  শুভকে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় কোনো আইনজীবী বা অভিভাবককে খবর দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার — থানায় শুভর কাছ থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ও নেওয়া হয়েছে!এটা কি হওয়ার কথা? গল্পটা প্রায়ই কিন্তু এই রকমই হয়।যেখানে শিশুর প্রতি স্নেহ, বোঝাপড়া এবং আইনের সংবেদনশীল অবস্থায় থাকার কথা, সেখানে অনেক সময়ই দেখা যায় অবহেলা, ভয়ভীতি এবং আইনের লঙ্ঘন। শুভর গল্প আমাদের চোখ খুলে দেয় — শিশুরা আসলে কী ধরনের বিপদের মুখোমুখি হয়।

শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী গ্রেপ্তার হওয়া শিশুর অধিকার

বাংলাদেশের শিশু আইন, ২০১৩ (Child Act, 2013) স্পষ্টভাবে বলে দেয়, ১৮ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তিকে “শিশু” হিসেবে বিবেচনা করা হবে। গ্রেপ্তারের সময় শিশুর জন্য বিশেষ সুরক্ষা বাধ্যতামূলক।

মূল বিধানগুলো হলো:

ধারা ৩৪: গ্রেপ্তারের সময় শিশুকে শিশু হিসেবেই গণ্য করতে হবে এবং তার বয়স যাচাই করতে হবে। ধারা ৩৬: গ্রেপ্তারের পর শিশুকে পৃথক হেফাজতে রাখতে হবে। সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে রাখা যাবে না। ধারা ৩৯: শিশুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশু আদালতে হাজির করতে হবে। ধারা ৪৯ ও ৫১: শিশুর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে, তদন্ত, বিচার এবং শাস্তি সবকিছুতেই শিশু বান্ধব ব্যবস্থা রাখতে হবে।

জামিন সংক্রান্ত বিষয়: ধারা ৪৯(১): শিশুর গ্রেপ্তারের পর সাধারণ নীতিমালা হলো তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া, যদি না গুরুতর কারণ দেখানো হয় কেন মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না। ধারা ৫০: শিশু আদালত জামিন দিতে বাধ্য, যদি শিশু সমাজে ফেরার পর অপরাধ করার সম্ভাবনা কম থাকে বা শিশুর মঙ্গল বিবেচনায় জামিন উপযুক্ত হয়।সুতরাং শিশুর জন্য জামিন হওয়া প্রাথমিক অধিকার — শাস্তির ব্যবস্থা নয়, পুনর্বাসনের সুযোগ নিশ্চিত করা।

গ্রেপ্তারের পর শিশুর মৌলিক অধিকার

বাংলাদেশের সংবিধানও শিশুর অধিকার সুরক্ষিত করেছে।সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে:কোনো শিশুকে অমানবিক, নিষ্ঠুর বা লাঞ্ছনাকর শাস্তি দেওয়া যাবে না।”

শিশু আইনের পাশাপাশি সংবিধানও পুলিশের দায়িত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে — শিশুর প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান বজায় রাখতে হবে।

উচ্চ আদালতের রায়: শিশুর মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশনা– বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বারবার শিশুদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সংবেদনশীল আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।

কিছু উল্লেখযোগ্য রায়: State vs Md. Rony (Criminal Appeal No. ৬৭/২০১৫): আদালত বলেন, “শিশুদের সঙ্গে আচরণ হতে হবে মাতৃস্নেহের মতো। বিচার বা তদন্তে শিশুর পুনর্বাসনই সর্বাগ্রে বিবেচিত হবে।”

BLAST & Others vs Government of Bangladesh (Writ Petition No. ৫৬৮৪/২০১০): আদালত নির্দেশ দেন, শিশুর গ্রেপ্তারে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং থানার কর্মীদের বাধ্যতামূলক শিশু অধিকার প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

State vs Md. Rubel (২০১৮): রায়ে বলা হয়, শিশু আসামিদের জামিনের আবেদন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করতে হবে। শিশুকে দীর্ঘদিন আটক রাখা সংবিধান পরিপন্থী।

বাস্তবতা: আইনের চেয়ে বাস্তব অনেক পিছিয়ে

বিভিন্ন আইন ও সনদে শিশুদের জন্য নিরাপত্তা থাকলেও বাস্তবে অবস্থা অনেক সময় ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়।UNICEF বাংলাদেশ ২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় প্রকাশ: ৪৩% শিশু থানায় গ্রেপ্তারের সময় মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অবগত হয়নি। ৩৫% শিশু আইনি সহায়তা ছাড়াই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ৩২% শিশু সাধারণ সেলে বড় আসামিদের সঙ্গে ছিল — যা স্পষ্ট আইনের লঙ্ঘন। (সূত্র: UNICEF Bangladesh, Child Justice Report 2023)

কেন শিশুরা অন্যায়ের শিকার হয়: চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

শিশুদের গ্রেপ্তারে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, পুলিশের শিশু অধিকার বিষয়ে অপ্রতুল প্রশিক্ষণ।পৃথক সেল বা হেফাজত ঘরের অভাব। গ্রেপ্তারের সময় আইনজীবী বা অভিভাবক উপস্থিত না থাকা।অভিভাবকদের আইনি সচেতনতার অভাব। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার কারণে শিশুদের অনর্থক আটক থাকা।

আশার আলো: কীভাবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে: কিছু থানায় চাইল্ড ডেস্ক স্থাপন। পুলিশ সদস্যদের জন্য শিশু অধিকার প্রশিক্ষণ শুরু। শিশু আদালতে আলাদা শুনানি সময় নির্ধারণ। জেলা আদালতে প্রবেশন অফিসার নিয়োগের উদ্যোগ।

একটি পরিসংখানে দেখা গ্যাছে অধিকাংশ শিশু আদালতের বিচারকগণ বলেছেন- আমরা এখন শিশুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই না; তাদের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলি।”এটা পরিবর্তনের এক উজ্জ্বল ইঙ্গিত।

গ্রেপ্তার হওয়া শিশু: সাধারণ প্রশ্ন উত্তর (FAQ)

১. শিশু কে বলা হয়? —- ১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। (শিশু আইন, ২০১৩, ধারা ৪)

২. শিশু গ্রেপ্তারের সময় কী করণীয়?—- শিশুর অভিভাবককে অবহিত করা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ নিশ্চিত করা।

৩. জামিন পাওয়ার সুযোগ কেমন?— শিশুদের ক্ষেত্রে জামিন প্রধান নীতি। গুরুতর কারণ ছাড়া জামিন না দেয়া যাবে না। (ধারা ৪৯)

৪. শিশুকে কোথায় রাখা হয়?— পৃথক শিশুবান্ধব হেফাজতে, সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে নয়।

৫. গ্রেপ্তারের সময় আইনজীবী থাকা কি বাধ্যতামূলক? –হ্যাঁ, শিশুর পক্ষ থেকে আইনজীবী বা সামাজিক কর্মী উপস্থিত থাকা উচিত।

৬. পুলিশের নির্যাতন হলে কী করা যায়?— শিশু আদালতে অভিযোগ করা যায় এবং প্রতিকার চাওয়া যায়।

৭. ১৬ বছরের শিশু কী বড়দের আদালতে যাবে?— না, বিশেষ শিশু আদালতে শুনানি হবে।

৮. শিশুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে কী হবে?— অভিযোগ খারিজ হবে এবং শিশুকে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া হবে।

৯. জামিন না পেলে শিশুর কী হবে? — আদালত নির্দিষ্ট কারণ ব্যতীত জামিন না দিলে বিকল্প ব্যবস্থার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. শিশু আইন ভাঙলে পুলিশের শাস্তি হয় কি?— হ্যাঁ, দায়িত্বে অবহেলা করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

উপসংহার: শিশুদের সম্ভাবনার পথে ফিরিয়ে আনা

শুভর মতো হাজার হাজার শিশুর জীবন নির্ভর করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।একটা ছোট ভুল কিংবা পুলিশি অজ্ঞতার কারণে কোনো শিশুর জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া মানবতার চরম পরাজয়। গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের অপরাধী হিসেবে নয়, পুনর্গঠনের সম্ভাবনা হিসেবে দেখতে হবে। আমাদের আইন, আদালত এবং সমাজকে শিশুদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে হবে।

শুভদের গল্প যেন কাঁদিয়ে থেমে না যায়। শুভরা যেন এগিয়ে যায়, সম্ভাবনার আলোয়।

আপনার মতামত দিন
Social Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Impact Financial

Good draw knew bred ham busy his hour. Ask agreed answer rather joy nature admire wisdom.

Latest Posts

  • All Posts
  • আইনগত পরামর্শ
  • আদালত সংক্রান্ত সেবা
  • আন্তর্জাতিক আইন
  • ই-বুক
  • কেস লিস্ট এস সি
  • গ্যালারি
  • গ্যালারি_১
  • জন সচেতনতা
  • ব্লগ
    •   Back
    • ফৌজদারি আইন
    • দেওয়ানী
    • ইনকাম টেক্স
    • ভোক্তা অধিকার
    • পারিবারিক

Categories

Tags

আমাদের সকল আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

You have been successfully Subscribed! Ops! Something went wrong, please try again.

আইন, অধিকার ও আইনী পরামর্শ।

আমাদের সম্পর্কে

কপিরাইট নোটিস

ট্রেড লাইসেন্স নংঃ ২৪০০৮৮২৫০১৯০০৭৩৮৯

ডিবিআইডি: ২৮৮৬৬৬৪৬০

গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক

যোগাযোগ করুন

আমাদের ফলো করুন:

আইনকথন.কম © ২০২৫
0
    0
    Your Cart
    Your cart is emptyReturn to Home
    Scroll to Top