মুসলিম নারীর তালাকের অধিকার
আমাদের সমাজে “তালাক” শব্দটি শুনলেই বেশিরভাগ মানুষের মনে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার মনে হয়। অথচ ইসলাম নারীকে শুধু সম্মানই নয়, বিবাহবিচ্ছেদের সুরক্ষিত পথও দিয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত একজন মুসলিম নারী কীভাবে তালাক নিতে পারেন, আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি কী, কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামের ভূমিকা কতটা—এই লেখায় সেসব প্রশ্নের জবাব থাকছে সহজ ভাষায়।
ইসলাম কি নারীদের তালাকের অধিকার দিয়েছে?
হ্যাঁ, তবে ‘খুলা’ নামে
ইসলামে নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম পন্থা হলো খুলা। এখানে স্ত্রী সম্পর্ক বিচ্ছেদের ইচ্ছা প্রকাশ করে, এবং স্বামীর সম্মতিতে দেনমোহর বা কিছু আর্থিক সুবিধা ত্যাগ করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
তালাকের অধিকার পুরোপুরি নারীর হাতে না থাকলেও ইসলামিক শরিয়াহ ও আধুনিক আইনে নারীর পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদের একাধিক উপায় রয়েছে—
খুলা (Khula)
তাওফিজ তালাক (Delegated Divorce)
ফাসখ তালাক (Judicial Divorce)
কাবিননামার ১৮ নম্বর কলাম ও তাফবিজ তালাক
তালাকের অধিকার নারীকে দেওয়া হলে কী হয়?
কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে যদি লেখা থাকে—“স্ত্রীকে তালাক প্রদানের অধিকার প্রদান করা হলো”—তবে নারী নিজেই তার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। একে বলা হয় তাওফিজ তালাক বা স্বামীর পক্ষ থেকে নারীর প্রতি তালাকের ক্ষমতা অর্পণ।
যদি ১৮ নম্বর কলাম খালি থাকে?
এ ক্ষেত্রে তালাক কার্যকর করার একমাত্র পথ হয়—খুলা বা আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ (Judicial Divorce)। অনেক নারী এই কলামের গুরুত্ব না বুঝে তা খালি রেখে দেন, ফলে পরবর্তীতে তালাক নিতে জটিলতার মুখে পড়েন।
একজন নারী কীভাবে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন?
১. খুলা: স্বামীর সম্মতির ভিত্তিতে
স্ত্রী যদি স্বামীর সাথে আর বসবাস করতে না চান, তবে তিনি খুলার জন্য আবেদন করতে পারেন। স্বামী সম্মত হলে দেনমোহর ফেরত দিয়ে তালাক কার্যকর হয়।
২. পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ (Judicial Divorce)
যদি স্বামী রাজি না হন বা নির্যাতনের প্রমাণ থাকে, তবে নারী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন। কারণ হিসেবে দেখাতে হবে-
- শারীরিক/মানসিক নির্যাতন
- ভরণ-পোষণের ব্যর্থতা
- যৌতুকের দাবি
- অন্য নারীতে আসক্তি বা পুনরায় বিয়ে
- স্বামীর পক্ষ থেকে সহবাসে অনীহা অথবা পুরুষত্বহীনতা
- ৪ বছর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহবাস না হওয়া
- ৪ বছর স্বামী নিখোঁজ বা পলাতক থাকা
মামলা কোথায় দায়ের করতে হবে?
নারীর স্থায়ী ঠিকানা বা বর্তমান বাসস্থানের পারিবারিক আদালতে (Family Court) এই মামলা দায়ের করতে হয়। পারিবারিক আদালত আইন, ১৯৬৫ অনুযায়ী, এই আদালতে ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’, ‘ভরণ-পোষণ’, ও ‘যৌতুক’ সংক্রান্ত মামলা শুনানি হয়।
উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত কী বলে?
খুলা ও নারীর স্বাধীনতা নিয়ে নজির স্থাপনকারী রায়:
BLD 2008, Vol-28, Page-332 (High Court Division) এই রায়ে উচ্চ আদালত বলেন—
“স্ত্রী যদি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সুযোগ না দেখেন, তবে স্বামীর সম্মতি ছাড়াও তিনি আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন। এটি তার মৌলিক অধিকার।”
অর্থাৎ, শুধুমাত্র স্বামীর অসম্মতি থাকলে স্ত্রী তালাক পাবে না—এই ধারণা ভুল। আদালত নারীর অভিযোগ, প্রমাণ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদন করতে পারেন।
বাস্তব গল্প: নার্গিসের মুক্তি
নার্গিস এর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে। প্রথম কয়েক বছর ভালো গেলেও পরবর্তীতে স্বামী নিয়মিত মারধর করতেন এবং যৌতুকের জন্য চাপ দিতেন। কাবিননামায় ১৮ নম্বর কলাম ফাঁকা থাকায় নিজে তালাক দিতে পারেননি। অবশেষে, তিনি খুলার আবেদন করেন। স্বামী সম্মত না হওয়ায় পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত শুনানি শেষে স্বামীর নির্যাতনের প্রমাণ পেয়ে নার্গিসকে বিচ্ছেদের অনুমতি দেন। এখন তিনি একটি এনজিওতে চাকরি করে নিজের সন্তানকে মানুষ করছেন।
তালাকের পর নারীর অধিকার
বিবাহবিচ্ছেদের পর নারী নিম্নোক্ত দাবিগুলো তুলতে পারেন:
- মোহরানা (দেনমোহর) দাবি
- ভরণপোষণ (ইদ্দতকালীন ও সন্তানের জন্য)
- সন্তানের হেফাজত ও দেখাশোনার অধিকার (যেটি আলাদা শুনানিতে নির্ধারিত হয়)
কিছু জরুরি পরামর্শ
কাবিননামা পড়েই স্বাক্ষর দিন—১৮ নম্বর কলামে আপনার অধিকার নিশ্চিত করুন।
আইনি সহায়তা নিন—মহিলা আইন সহায়তা কেন্দ্র, লিগ্যাল এইড, বা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহায়তা নিন।
আইন ও তালাক প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হোন—বিষয়টি শুধু ধর্মীয় না, আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
উপসংহার: তালাক মানেই পরাজয় নয়, নিজের অধিকার চাওয়া
“তালাক” শুনলেই যেন চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে, নারী যেন একা পড়ে যান—এই সংস্কার বদলাতে হবে। তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি নিজের আত্মসম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষার একটি আইনসম্মত উপায়।
তাই, ইসলাম এবং বাংলাদেশের আইন—দুই জায়গাতেই নারীদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক ও মানবিক পথ।