“আমার টাকা মেরে দিয়েছে!”, “৪২০-এর মামলা দেবো!” – আর্থিক লেনদেন বা চুক্তি সংক্রান্ত ঝামেলায় পড়লে আমরা অনেকেই এই কথাগুলো বলি। কিন্তু আপনি কি জানেন, বাংলাদেশের আইনে প্রতারণা বা অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত মামলায় দন্ডবিধির ৪০৬ ধারা এবং ৪২০ ধারা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অপরাধের জন্য বলা হয়েছে?
প্রায়শই দেখা যায়, অভিযোগের সাথে ধারার মিল থাকে না। এর ফলে মামলা দুর্বল হয়ে যায় বা প্রত্যাশিত ফলাফল আসে না। সাধারণ মানুষের জন্য এই দুটি ধারার পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত জরুরি। চলুন, খুব সহজ ভাষায় জেনে নিই কখন কোন ধারা প্রযোজ্য হবে, এদের মূল ফারাক কোথায়, এবং এ বিষয়ে আমাদের উচ্চ আদালত কী বলেন।
Table of Contents
Toggleভূমিকা: কেন ৪০৬ ও ৪২০ ধারা বোঝা দরকার?
ধরুন, আপনার বন্ধু আপনার কাছে কিছু টাকা আপনার প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য রাখলো, কিন্তু পরে সেই টাকা সে আর ফেরত দিল না বা অন্য কোথাও খরচ করে ফেললো। অথবা, কেউ আপনাকে লোভনীয় চাকরির বা ব্যবসার কথা বলে আপনার কাছ থেকে টাকা নিল, কিন্তু আসলে এমন কোনো চাকরি বা ব্যবসাই নেই!
প্রথম ঘটনাটি একরকম অপরাধ, আর দ্বিতীয়টি আরেকরকম। আমাদের দন্ডবিধি এই দুই ধরনের কাজকে আলাদাভাবে দেখে এবং তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধারা ও শাস্তির বিধান রেখেছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা দন্ডবিধির ৪০৬ ধারা (বিশ্বাসভঙ্গ) এবং ৪২০ ধারা (প্রতারণা) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার বা পরিচিত কারো সাথে অন্যায় হলে আসলে কোন ধারায় মামলা করা উচিত।
ধারা ৪০৬: আস্থার অবহেলা বা বিশ্বাসভঙ্গ (Criminal Breach of Trust)
সহজ কথায়: ৪০৬ ধারা প্রযোজ্য হয় যখন আপনি কারো ওপর বিশ্বাস করে বা আস্থা রেখে আপনার কোনো সম্পদ (টাকা, জিনিসপত্র) তার কাছে গচ্ছিত রাখেন বা কোনো দায়িত্ব দেন, কিন্তু সে আপনার সেই আস্থার মর্যাদা না রেখে সেই সম্পদ বা দায়িত্ব নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে বা অন্য কাউকে দিয়ে দেয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে সম্পদ বা দায়িত্বটি আপনার বিশ্বাসের কারণে বৈধভাবেই গিয়েছিল। অপরাধটি ঘটে পরে, যখন সে সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করে আপনার সম্পদ বা দায়িত্বের অপব্যবহার করে।
কখন এই ধারা ব্যবহার হয়? বাস্তব উদাহরণ:
- অফিসের ক্যাশিয়ার বা কোষাধ্যক্ষ: অফিসের ক্যাশে টাকা রাখার দায়িত্ব তার, কিন্তু সে কিছু টাকা সরিয়ে ফেলল। এখানে অফিসের বিশ্বাস ভঙ্গ করা হয়েছে।
- জামানত বা গচ্ছিত সম্পদ: আপনি আপনার বন্ধুর কাছে জরুরি প্রয়োজনে কিছু মূল্যবান গহনা বা টাকা রাখলেন, কিন্তু সে সেটা আপনাকে ফেরত না দিয়ে নিজে ব্যবহার করে ফেলল বা বিক্রি করে দিল।
- চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া সম্পদ: কোনো চুক্তির অধীনে আপনি কাউকে কোনো কাজের জন্য বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পদ বা টাকা দিয়েছেন (যেমন, বাড়ি তৈরির জন্য ঠিকাদারকে টাকা দেওয়া), কিন্তু সে টাকা নিয়ে কাজটি করলো না বা অর্ধেক করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করলো।
- পার্টনারশিপের টাকা: ব্যবসার অংশীদার হিসেবে অন্য অংশীদারদের অজান্তে বা সম্মতি ছাড়া ব্যবসার টাকা ব্যক্তিগত কাজে খরচ করা।
শাস্তি: এই ধারার অধীনে অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।
জামিনযোগ্যতা: ৪০৬ ধারা সাধারণত জামিনযোগ্য নয়। তবে মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকেই শর্ত সাপেক্ষে জামিন কখনো কখনো পাওয়া যেতে পারে, যদিও মামলার পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি ভিন্ন হতে পারে।
প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ: এই ধারায় মামলা সফল করতে হলে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে আপনি অভিযুক্তকে আপনার সম্পদ বিশ্বাস করে বা আস্থা রেখে দিয়েছিলেন (entrusted with property)। আপনার কাছে প্রমাণ থাকতে হবে যে সম্পদ তার কাছে আইনত গচ্ছিত ছিল এবং সে সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: আমাদের উচ্চ আদালত বিভিন্ন রায়ে ৪০৬ ধারা প্রসঙ্গে স্পষ্ট করেছেন যে, কেবল চুক্তি ভঙ্গ করাই ৪০৬ ধারা নয়। যদি প্রমাণ করা যায় যে চুক্তির অংশ হিসেবে দেওয়া কোনো সম্পদ বা টাকা বিশ্বাস করে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল এবং সেটি পরে আত্মসাৎ করা হয়েছে, কেবল তখনই ৪০৬ ধারা প্রযোজ্য হবে। নতুবা এটি দেওয়ানি মামলার বিষয়।
ধারা ৪২০: প্রতারণা (Cheating & Dishonest Inducement)
সহজ কথায়: ৪২০ ধারা প্রযোজ্য হয় যখন কেউ প্রথম থেকেই খারাপ বা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে (মিথ্যা কথা বলে, ভুল তথ্য দিয়ে, সত্য গোপন করে বা ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে) আপনাকে ঠকায় এবং এই প্রতারণার মাধ্যমে আপনার কাছ থেকে টাকা বা অন্য কোনো সম্পদ হাতিয়ে নেয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: এখানে প্রতারণাকারী প্রথম থেকেই আপনাকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে। তার মিথ্যা বা জালিয়াতির কারণেই আপনি তাকে আপনার সম্পদ দিতে রাজি হন। অপরাধটি ঘটে সম্পদ হস্তান্তরের আগেই বা ঠিক সম্পদ হস্তান্তরের সময়, কারণ প্রতারণার উদ্দেশ্য শুরু থেকেই থাকে।
কখন এই ধারা ব্যবহার হয়? বাস্তব উদাহরণ:
- ভুয়া চাকরির প্রলোভন: আপনাকে একটি দারুণ চাকরির অফার দেওয়া হলো, বলা হলো ‘নিশ্চিত চাকরি’, আর এই কথা বলে আপনার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হলো। কিন্তু আসলে এমন কোনো চাকরিই নেই।
- জাল কাগজপত্র দেখিয়ে সম্পদ বিক্রি: কেউ আপনাকে জাল দলিল বা কাগজপত্র দেখিয়ে এমন কোনো জমি বা সম্পত্তি বিক্রি করলো যার আসল মালিকানা তার নেই।
- অনলাইন বা সামাজিক মাধ্যমে স্ক্যাম: ফেসবুকে বা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে ভুয়া পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে বা লটারি জেতার কথা বলে আপনার কাছ থেকে টাকা নেওয়া।
- লটারি বা পুরস্কারের নামে টাকা আদায়: আপনাকে বলা হলো আপনি বড় অঙ্কের লটারি জিতেছেন, কিন্তু সেই টাকা পেতে হলে আগে কিছু প্রসেসিং ফি বা ট্যাক্স দিতে হবে। আপনি সেই ফি দিলেন, কিন্তু কোনো লটারির টাকা পেলেন না।
- ভুয়া কোম্পানি বা স্কিম: দ্রুত টাকা দ্বিগুণ করার বা দারুণ লাভজনক ব্যবসার কথা বলে আপনার কাছ থেকে বিনিয়োগ আদায় করা, কিন্তু আসলে এমন কোনো লাভজনক ব্যবসাই নেই।
শাস্তি: এই ধারার অধীনে অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।
জামিনযোগ্যতা: ৪২০ ধারা জামিনযোগ্য (bailable)। অর্থাৎ, এই ধারায় মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে জামিন পাওয়া যায় ।
প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ: ৪২০ ধারায় সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো প্রমাণ করা যে অভিযুক্তের প্রতারণার বা ঠকানোর উদ্দেশ্যটি প্রথম থেকেই ছিল। শুধুমাত্র চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে বা টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি – এইটুকু প্রমাণ করাই যথেষ্ট নয়। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে তার উদ্দেশ্যই ছিল আপনাকে ঠকানো এবং সেই কারণেই আপনি আপনার সম্পদ হারিয়েছেন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: উচ্চ আদালত বিভিন্ন রায়ে স্পষ্ট করেছেন যে, ৪২০ ধারার মূল ভিত্তি হলো অসৎ উদ্দেশ্য (dishonest intention) এবং সেই উদ্দেশ্যের কারণে প্রতারিত হয়ে সম্পদ হস্তান্তর (inducement to deliver property)। যদি লেনদেনের সময় প্রতারণার উদ্দেশ্য না থাকে, কেবল টাকা ফেরত না দিলেই ৪২০ ধারা হয় না। এটি সাধারণত দেওয়ানি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
৪০৬ বনাম ৪২০ ধারার মূল পার্থক্য (এক নজরে)
বৈশিষ্ট্য | ধারা ৪০৬ (বিশ্বাসভঙ্গ) | ধারা ৪২০ (প্রতারণা) |
অপরাধের সময় | আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর সম্পদ আত্মসাৎ বা অপব্যবহার। | সম্পদ আদায়ের উদ্দেশ্যেই প্রতারণা, যা প্রথম থেকেই থাকে। |
উদ্দেশ্য | আত্মসাতের উদ্দেশ্য পরবর্তীতে তৈরি হতে পারে। | প্রতারণার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য প্রথম থেকেই বিদ্যমান থাকে। |
সম্পদের দখল | আপনার বিশ্বাসের ভিত্তিতে বৈধ বা আস্থামূলক দখল। | প্রতারণা বা মিথ্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে দখল। |
মূল কাজ | আস্থার অবহেলা বা গচ্ছিত সম্পদের অপব্যবহার। | মিথ্যা বা জালিয়াতি করে ঠকানো। |
শাস্তির মাত্রা | সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদন্ড। | সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ড। |
জামিনযোগ্যতা | জামিনযোগ্য নয় | জামিনযোগ্য। |
টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দিলে বা চুক্তিভঙ্গ করলে কোন ধারা?
এটি একটি খুব সাধারণ প্রশ্ন। সহজ উত্তর হলো:
- টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দিলে: এটি সাধারণত একটি দেওয়ানি মামলা। দন্ডবিধির ৪০৬ বা ৪২০ ধারায় মামলা করার সুযোগ কম, যদি না আপনি সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেন যে টাকা ধার নেওয়ার সময় থেকেই তার উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ঠকানো বা ফেরত না দেওয়া। শুধু ফেরত না দেওয়াটা ফৌজদারি অপরাধ নয়।
- চুক্তি ভঙ্গ করলে: কেবলমাত্র চুক্তি ভঙ্গ করাও সাধারণত একটি দেওয়ানি মামলা। যেমন, কেউ নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না করলো বা চুক্তির শর্ত মানলো না। এটি দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা হতে পারে। তবে, যদি চুক্তি ভঙ্গের সাথে সাথে আপনার দেওয়া কোনো সম্পদ বা টাকা আত্মসাৎ করার উপাদান থাকে (যেমন, চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া টাকা নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাজ না করে টাকাটা মেরে দেওয়া) এবং তা ৪০৬ বা ৪২০ ধারার শর্ত পূরণ করে, তবে ফৌজদারি মামলাও হতে পারে। মূল বিষয় হলো সেখানে বিশ্বাসভঙ্গ বা প্রতারণার উপাদান থাকতে হবে।
উচ্চ আদালতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বিভিন্ন মামলায় ৪০৬ ও ৪২০ ধারার প্রয়োগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো:
১. ধারা ৪০৬ সম্পর্কিত:
- কেসের নাম: মোঃ হাবিবুর রহমান বনাম রাষ্ট্র
রেফারেন্স: Bangladesh Legal Decisions (BLD), 2008, খণ্ড 60, পৃঃ ২৫৬
বিষয়: অভিযুক্তকে গচ্ছিত টাকা ফেরত না দেওয়াকে “ক্রিমিনাল ব্রিচ অব ট্রাস্ট” হিসেবে গণ্য করে আদালত ৪০৬ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন। - কেসের নাম: রাষ্ট্র বনাম নাসির উদ্দিন আহমেদ
রেফারেন্স: 56 DLR (Dhaka Law Reports) 2004, পৃঃ ১২৩
বিষয়: চুক্তি অনুযায়ী সম্পদের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও আত্মসাতের ঘটনায় ৪০৬ ধারা প্রয়োগ।
২. ধারা ৪২০ সম্পর্কিত:
- কেসের নাম: রাষ্ট্র বনাম এজাজুল হক
রেফারেন্স: BLD 2019, খণ্ড 71, পৃঃ ৪৫০
বিষয়: ভুয়া প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলনকে “প্রতারণা” হিসেবে চিহ্নিত করে ৪২০ ধারায় শাস্তি। - কেসের নাম: সেলিনা বেগম বনাম রাষ্ট্র
রেফারেন্স: 52 DLR 2000, পৃঃ ৩০২
বিষয়: জাল কাগজপত্র দেখিয়ে জমি বিক্রির ঘটনায় ৪২০ ধারা প্রযোজ্য বলে রায় দেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বিভিন্ন মামলায় ৪০৬ ও ৪২০ ধারার প্রয়োগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যা নিচে দেয়া হলোÑ
- প্রতারণার উদ্দেশ্য: ৪২০ ধারার জন্য অভিযুক্তের প্রাথমিক ও মৌলিক উদ্দেশ্যই প্রতারণা ছিল – এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। শুধুমাত্র টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়া বা চুক্তি পূরণ করতে না পারাটা প্রতারণা নয়।
- বিশ্বাসভঙ্গের প্রমাণ: ৪০৬ ধারার জন্য প্রমাণ করতে হবে যে সম্পদটি বিশ্বাস করে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল এবং সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
- দেওয়ানি বনাম ফৌজদারি: আদালত সবসময় দেখেন যে অভিযোগটি আসলে দেওয়ানি (চুক্তি বা আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত) নাকি ফৌজদারি (অপরাধমূলক)। কেবলমাত্র আর্থিক বিরোধ হলেই তা ফৌজদারি মামলা হবে এমন নয়। সেখানে অপরাধের উপাদান, যেমন – প্রতারণা বা বিশ্বাসভঙ্গের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে।
- ধার ও ৪২০: টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়াকে অনেক সময় ৪২০ ধারায় ফেলার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু আদালত এ ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। যদি ধার নেওয়ার সময় প্রতারণার উদ্দেশ্য প্রমাণ না করা যায়, তবে এটি দেওয়ানি বিষয়।
প্রতারণা বা বিশ্বাসভঙ্গের শিকার হলে আপনার করণীয়:
১. প্রমাণ সংগ্রহ: সকল প্রকার লিখিত চুক্তি, মেসেজ, ইমেইল, টাকা লেনদেনের রসিদ বা প্রমাণ, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এবং সাক্ষীদের তালিকা ও বক্তব্য সংগ্রহ করুন। এগুলো আপনার মামলার মূল ভিত্তি। ২. আইনজীবীর পরামর্শ: যত দ্রুত সম্ভব একজন অভিজ্ঞ ফৌজদারি আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন। তিনি আপনার ঘটনা শুনে কোন ধারায় মামলা করলে সেটি শক্তিশালী হবে এবং কীভাবে প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে সে বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারবেন। ৩. থানায় অভিযোগ: আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার (FIR) দায়ের করুন অথবা আদালতে সরাসরি মামলা (Complaint Case) দায়েরের জন্য আবেদন করুন।
কিছু সচরাচর জিজ্ঞাসা (FAQ):
- প্রশ্ন: দুটো ধারায় একসাথে মামলা করা যায় কি? উত্তর: হ্যাঁ, যদি কোনো অপরাধের ঘটনায় বিশ্বাসভঙ্গ এবং প্রতারণা – দুটো উপাদানেরই প্রমাণ থাকে, তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক ধারায় অভিযোগ আনা যেতে পারে। তবে এটি নির্ভর করে ঘটনার প্রকৃতির উপর।
- প্রশ্ন: শুধু মৌখিক কথায় টাকা ধার দিয়ে ঠকলে ৪২০ বা ৪০৬ ধারা কি প্রযোজ্য হবে? উত্তর: মৌখিক কথার চেয়ে লিখিত প্রমাণ অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে মৌখিক কথার ভিত্তিতেও মামলা হতে পারে, যদি ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও সাক্ষীর মাধ্যমে বিশ্বাসভঙ্গ বা প্রতারণার উদ্দেশ্য প্রমাণ করা যায়। প্রমাণ করাটা কঠিন হতে পারে।
- প্রশ্ন: মামলা শেষ হতে কত সময় লাগে? উত্তর: মামলার সময়কাল বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন – প্রমাণের সহজলভ্যতা, সাক্ষীর উপস্থিতি, আদালতের কাজের চাপ ইত্যাদি। সাধারণত ২ বছর থেকে ৫ বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।
- প্রশ্ন: ৪২০ ধারায় জামিন পাওয়া কি খুব কঠিন? উত্তর: হ্যাঁ, ৪২০ ধারা জামিন অযোগ্য। জামিন পেতে হলে আপনাকে দায়রা আদালত বা উচ্চ আদালতে আবেদন করতে হবে এবং আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে আপনাকে জামিন দিলে মামলার বিচার বাধাগ্রস্ত হবে না বা আপনি ন্যায়বিচার থেকে পালিয়ে যাবেন না।
উপসংহার: আপনার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন
দন্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারা দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি ধারার মূল পার্থক্য হলো অপরাধীর উদ্দেশ্য কখন তৈরি হয়েছিল এবং সম্পদ কীভাবে তার দখলে এসেছিল। বিশ্বাসভঙ্গ মানে হলো আগে বিশ্বাস ছিল, পরে সেটি ভাঙা হয়েছে; আর প্রতারণা মানে হলো প্রথম থেকেই ঠকানোর পরিকল্পনা ছিল।
আইন শুধু বইয়ের পাতায় নয়, এটি আপনার everyday life-এর সাথে জড়িত। আপনার অধিকার জানা এবং সঠিক ধারায় প্রতিকার চাওয়া আপনার জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সহজ করে দেবে। যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এমন কোনো ঘটনার শিকার হন, তবে সময় নষ্ট না করে সকল প্রমাণ গুছিয়ে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিন। কারণ, প্রতিটি মামলার সফলতা নির্ভর করে সঠিক আইনি পদক্ষেপ এবং উপযুক্ত প্রমাণের উপর।
আশা করি এই ব্লগ পোস্টটি আপনাকে ৪০৬ ও ৪২০ ধারার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করবে। আপনার যেকোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।