ainkhathon@gmail.com
Edit Template

বাংলাদেশের যৌতুক নিরোধ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যৌতুক এর জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত ধারার বিশ্লেষন

যৌতুক – ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে হাজারো নারীর কান্না, অপমান আর নির্যাতনের গল্প। আমাদের সমাজে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে থাকা এই প্রথাটি কেড়ে নিচ্ছে বহু নারীর মুখের হাসি, এমনকি জীবনও। তবে আশার কথা হলো, এই অন্যায় রুখতে আমাদের দেশেই রয়েছে শক্তিশালী আইন। যৌতুকের অভিশাপ থেকে নারীদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেছে। আসুন, এই আইনগুলো সম্পর্কে সহজভাবে জেনে নিই এবং আমাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই।

যৌতুক চাইলেই অপরাধ:

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ (ধারা )শুধু যৌতুক দেওয়া-নেওয়া নয়, যৌতুক দাবি করাও একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ নম্বর ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:

অপরাধ: যদি কেউ বিয়েতে বা বিয়ের পরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে (সরাসরি চেয়ে বা ইশারায়/চাপ দিয়ে) যৌতুক দাবি করেন।

শাস্তি: সর্বনিম্ন ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০,০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

সহজ কথায়: কেউ যদি আপনার কাছে বা আপনার পরিবারের কাছে বিয়ের শর্ত হিসেবে বা বিয়ের পরে টাকা, আসবাব, গাড়ি বা অন্য কিছু চায়, সেটাই যৌতুক দাবি এবং আইনের চোখে অপরাধ।

যৌতুকের জন্য নির্যাতন? নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (ধারা ১১)

যৌতুকের দাবি যদি গড়ায় শারীরিক নির্যাতনে, তাহলে তা আরও গুরুতর অপরাধ। এই ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০( সংশোধনী ২০০৩ ) এ। এই আইনের ১১ নম্বর ধারায় যৌতুকের জন্য নির্যাতনের বিভিন্ন শাস্তির কথা বলা আছে। বিশেষ করে ধারা ১১() অনুযায়ী:

  • অপরাধ: যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে যদি সাধারণ মারধর বা শারীরিক নির্যাতন (Simple Hurt) করা হয়।
  • শাস্তি: সর্বনিম্ন ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড (অর্থাৎ জেলে খাটুনির সাথে কাজও করতে হবে) এবং এর সাথে অতিরিক্ত জরিমানাও হতে পারে। ( ২০২৫ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী )

মূল কথা: যৌতুকের জন্য গায়ে হাত তোলা বা যেকোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন মারাত্মক অপরাধ এবং এর জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে।

কোন আইনে কী পার্থক্য? এক নজরে

বৈশিষ্ট্যযৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ (ধারা )নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন (ধারা ১১/গ)
মূল অপরাধশুধু যৌতুক দাবি করাযৌতুকের জন্য মারধর/নির্যাতন করা
শাস্তি (জেল)১ থেকে ৫ বছর২থেকে ৫ বছর (সশ্রম)
শাস্তি (জরিমানা)সর্বোচ্চ ৫০,০০০ টাকাজেলের সাথে অতিরিক্ত জরিমানা
জামিনজামিন যোগ্য নয়, তবে জামিন পাওয়া যায়জামিনযোগ্য নয়
আপোষকরা যায়আপোষযোগ্য নয়
বিচার কোথায় হয়ম্যাজিস্ট্রেট আদালতনারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল

কোথায়, কিভাবে এবং কোন আইনে মামলা করবেন?

আইনি সুরক্ষা পেতে হলে, ঠিক কী ঘটেছে তার ওপর ভিত্তি করে সঠিক আইন বাছাই করতে হবে এবং সঠিক জায়গায় অভিযোগ জানাতে হবে। আসুন দেখি কখন, কোথায় এবং কোন আইনের সাহায্য নেবেন:

পরিস্থিতি ১: শুধু যৌতুক দাবি করা হয়েছে (কোনো মারধর বা নির্যাতন হয়নি)   :   

কোন আইন প্রযোজ্য? যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ (ধারা ৩)। কারণ এখানে মূল অপরাধ হলো যৌতুক “দাবি” করা।

কোথায় ও কিভাবে অভিযোগ করবেন?  

বিকল্প ১: আপনার নিকটস্থ থানায় গিয়ে লিখিত এজাহার (FIR) দাখিল করতে পারেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করবে।

বিকল্প ২: আপনি সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) নালিশি মামলা দায়ের করতে পারেন। এতে পুলিশের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।

পরিস্থিতি : যৌতুকের জন্য মারধর, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে:

কোন আইন প্রযোজ্য? নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (ধারা ১১)। কারণ এখানে দাবির পাশাপাশি “নির্যাতন” বা “জখম” ঘটানো হয়েছে। (সাধারণ মারধরের জন্য ধারা ১১(গ), প্রযোজ্য)। 

কোথায় ও কিভাবে অভিযোগ করবেন?

বিকল্প ১: যত দ্রুত সম্ভব থানায় গিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে এজাহার (FIR) দায়ের করুন। পুলিশ তদন্ত করে মামলাটি বিচারের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠাবে। (নির্যাতনের শিকার হলে দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি)।

বিকল্প : আপনি চাইলে থানার মাধ্যমে না গিয়ে, সরাসরি নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন (এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী)। এক্ষেত্রে নির্যাতনের সপক্ষে প্রমাণ (যেমন ডাক্তারের সার্টিফিকেট, ঘটনার সাক্ষী) আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।

গুরুত্বপূর্ণ টিপস

 যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা – দাবির রেকর্ড (অডিও/ভিডিও/লিখিত) থাকলে মামলা শক্তিশালী হয়। -মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
. ধারা ১১/ মামলা (নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ )– নির্যাতনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা করান। থানার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা এনজিওর সহায়তা নিন।

বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

আইন থাকলেও যৌতুকের অভিশাপ সমাজ থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর (যেমন আইন ও সালিশ কেন্দ্র – ASK, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) তথ্যমতে, যৌতুকের জন্য সহিংসতা এখনও ঘটে চলেছে। এর পেছনের কিছু কারণ:                         

সামাজিক লজ্জা: অনেকে সম্মানহানির ভয়ে বা পরিবারের চাপে অভিযোগ করতে চান না।   – ৬৭% ক্ষেত্রে পরিবার মামলা করতে চায় না (সোশ্যাল স্টিগমা)

প্রমাণের সমস্যা: বিশেষ করে শুধু দাবির ক্ষেত্রে বা পরোক্ষ চাপের ক্ষেত্রে প্রমাণ জোগাড় করা কঠিন হয়। ৪০% মামলা প্রমাণের অভাবে খারিজ হয়                                                                                                             

দীর্ঘসূত্রিতা: বিচার পেতে অনেক সময় লেগে যায়। গড়ে ১,৪২০ দিন লাগে একটি মামলা নিষ্পত্তিতে।

আসুন, রুখে দাঁড়াই

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। শুধু আইন দিয়ে একে নির্মূল করা কঠিন। প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

  • সচেতন হোন, সচেতন করুন: নিজের অধিকার জানুন, অন্যকে জানান। যৌতুকের কুফল নিয়ে পরিবারে, সমাজে আলোচনা করুন।
  • সাহসী হোন: অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করুন, প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নিন।
  • সামাজিকভাবে বর্জন করুন: যৌতুক লেনদেনকে সামাজিকভাবে ঘৃণা করতে শিখি, এমন বিয়েতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকি।

মনে রাখবেন, আপনার নীরবতা অপরাধীকে আরও সাহস যোগায়। যৌতুকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন, একটি সুন্দর নিরাপদ সমাজ গড়তে সাহায্য করুন।

তথ্যসূত্র:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Impact Financial

Good draw knew bred ham busy his hour. Ask agreed answer rather joy nature admire wisdom.

Latest Posts

  • All Posts
  • আইনগত পরামর্শ
  • আদালত সংক্রান্ত সেবা
  • আন্তর্জাতিক আইন
  • ই-বুক
  • কেস লিস্ট এস সি
  • গ্যালারি
  • গ্যালারি_১
  • জন সচেতনতা
  • ব্লগ
    •   Back
    • ফৌজদারি আইন
    • দেওয়ানী
    • ইনকাম টেক্স
    • ভোক্তা অধিকার
    • পারিবারিক

Categories

Tags

আমাদের সকল আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

You have been successfully Subscribed! Ops! Something went wrong, please try again.

আইন, অধিকার ও আইনী পরামর্শ।

আমাদের সম্পর্কে

কপিরাইট নোটিস

ট্রেড লাইসেন্স নংঃ ২৪০০৮৮২৫০১৯০০৭৩৮৯

ডিবিআইডি: ২৮৮৬৬৬৪৬০

গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক

যোগাযোগ করুন

আমাদের ফলো করুন:

আইনকথন.কম © ২০২৪ ডেভেলপার আতিকুর রহমান

Scroll to Top