বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী : ইতিহাস ও বিশ্লেষণ এবং জনগণের প্রত্যাশা
বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী (১৯৭৩-২০১৮) (১৯৭৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সকল সংশোধনীর প্রভাব, বিতর্ক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট) বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইনি দলিল, যা রাষ্ট্রের মূলনীতি, নাগরিক অধিকার ও শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালে প্রণয়নের পর থেকে ১৭টি সংশোধনী এই দলিলকে রূপান্তরিত করেছে, যার প্রতিটিই এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমরা আজকে প্রতিটি সংশোধনীর পেছনের কারন, প্রভাব ও বিভিন্ন বিতর্ক সমূহ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবো। ১ম সংশোধনী (১৯৭৩): যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনি ভিত্তি মূল বিষয়: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িতদের বিচারের জন্য সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন। বিস্তারিত প্রভাব:ট্রাইব্যুনাল গঠন: এই সংশোধনীর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের পথ তৈরি হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) গঠিত হয়।মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ: অভিযুক্তদের জামিনের অধিকার স্থগিত করা হয়, যা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার কারণ হয় (আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ১৯৭৩)।রাজনৈতিক বিভাজন: আওয়ামী লীগ এটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারে ভূমিকা উল্লেখ করলেও বিএনপি-জামায়াত জোট এটিকে “প্রতিশোধমূলক” বলে সমালোচনা করে।বিতর্ক: সংবিধানের “আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকার” নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। ২য় সংশোধনী (১৯৭৩): জরুরি অবস্থার অপব্যবহার মূল বিষয়: জরুরি অবস্থা জারি করে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি।বিস্তারিত প্রভাব: ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মৌলিক অধিকার স্থগিতসহ যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারতেন।দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবঃ ২০০৭-২০০৮ সালের সংকট- তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে ২ বছর দেশ চালায়। এ সময় ১.৫ লক্ষ মানুষ গ্রেফতার হন (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ২০০৮)।অর্থনৈতিক ধস: জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬% থেকে ৫%-এ নেমে আসে (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০০৮)।বিতর্ক: জরুরি অবস্থাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। ৩য় সংশোধনী (১৯৭৪): ছিটমহল বিনিময় মূল বিষয়: ভারতের সাথে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের অনুমোদন।বিস্তারিত প্রভাব-মানবিক সাফল্য: ৫০,০০০ মানুষ নাগরিকত্ব পায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত হয়।২০১৫ সালের চূড়ান্ত বিনিময়: মোদি-হাসিনা চুক্তির মাধ্যমে ৬৮ বছরের সমস্যার সমাধান হয়।ভূ-রাজনৈতিক সমালোচনা: বাংলাদেশ ১১১টি ছিটমহল ছেড়ে দিয়ে ভারতের কাছ থেকে পায় মাত্র ৫১টি (ড. কামাল হোসেন, “বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস”)।বিতর্ক: অসম বিনিময়কে “ভারতের সাথে দুর্বল কূটনীতি” বলা হয়। ৪র্থ সংশোধনী (১৯৭৫): একদলীয় শাসন (বাকশাল) মূল বিষয়: সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করে রাষ্ট্রপতিশাসিত একদলীয় সরকার চালু।বিস্তারিত প্রভাব- গণতন্ত্রের মৃত্যু: সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল একমাত্র বৈধ দল হয়।মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ: মাত্র ৪টি সংবাদপত্র চালুর অনুমতি দেওয়া হয়।১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ: ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা বাকশালের অদক্ষতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত (ড. অনুসূয়া সাহা, “বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস”)।বিতর্ক: “গণতন্ত্র হত্যার প্রথম ধাপ” হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত। ৫ম সংশোধনী (১৯৭৯): জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন বৈধতা মূল বিষয়: ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমানের শাসনকে বৈধতা দেওয়া।বিস্তারিত প্রভাব- সামরিক শাসনের নজির:পরবর্তীতে এরশাদও ১৯৮২ সালে একই পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল করেন।রাজনৈকিত দল গঠন: জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP) গঠন করেন, যা আজও বাংলাদেশের একটি অন্যকম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল।২০১০ সালে বাতিল: সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, “সামরিক শাসন সংবিধানবিরোধী” (মামলা নং: ৫/২০১০)।বিতর্ক: সংবিধানে সামরিক হস্তক্ষেপের বৈধতা দেওয়াকে “গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা” বলা হয়। ৬ষ্ঠ সংশোধনী (১৯৮১): রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নিয়ম পরিবর্তন মূল বিষয়: রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের নির্বাচনের আগে পদত্যাগ বাধ্যতামূলক নয়।বিস্তারিত প্রভাব-ক্ষমতার অপব্যবহার: রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় পুনর্নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারি সম্পদ ব্যবহার করা এবং র্নির্বাচনকে প্রভাবিত করা।বিতর্ক: “নির্বাচনের সততা নষ্ট” – এই সংশোধনীকে সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে বিশিষ্ঠ জনের মতামত। ৭ম সংশোধনী (১৯৮৬): এরশাদের সামরিক শাসন বৈধতা মূল বিষয়: সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ১৯৮২ সালের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়া।বিস্তারিত প্রভাব:গণঅসন্তোষ বৃদ্ধি: ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।রাজনৈতিক দল গঠন: এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যা এখনও রাজনীতির মাঠে সক্রিয়।২০১০ সালে বাতিল: আদালত রায় দেয়, “সামরিক শাসন কখনো বৈধ নয়”।বিতর্ক: সংবিধানকে “সামরিক শাসকের হাতিয়ার” হিসেবে ব্যবহারের নজির। ৮ম সংশোধনী (১৯৮৮): ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম মূল বিষয়:সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা।বিস্তারিত প্রভাব:ধর্মীয় বিভাজন: সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলা বৃদ্ধি পায় (মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ, ২০২০)।শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন: মাদ্রাসা শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।বিতর্ক: সংবিধানের মূল স্তম্ভ “ধর্মনিরপেক্ষতা” এর সাথে সাংঘর্ষিক। ৯ম সংশোধনী (১৯৮৯): রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সরাসরি ভোট মূল বিষয়: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সরাসরি ভোট পদ্ধতি চালু।বিস্তারিত প্রভাব:ব্যবহারিক ব্যর্থতা: ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকার ফিরে এলে সংশোধনীর প্রাসঙ্গিকতা হারায়।বিতর্ক: সময়ের সঙ্গে বেমানান এবং অপ্রয়োজনীয় সংশোধনী। ১০ম সংশোধনী (১৯৯০): নারী আসন সংরক্ষণ মূল বিষয়: সংসদে ৩০টি সংরক্ষিত নারী আসন চালু।বিস্তারিত প্রভাব:প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব: নারীর উপস্থিতি ২% থেকে ১০%-এ ওঠে, কিন্তু মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব।স্থানীয় সরকারে প্রভাব: উপজেলা পর্যায়ে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়।বিতর্ক: এটাকে প্রিতিনিধিত্ব নয়, দলীয় কোটা বলে আলোচিত হয়। ১১তম সংশোধনী (১৯৯১): বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি পদ মূল বিষয়: প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি করা।বিস্তারিত প্রভাব:নিরপেক্ষ নির্বাচন: ১৯৯১ সালে প্রথম অবাধ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।বিতর্ক: “বিচার বিভাগের রাজনীতিকরণ” বলে আলোচনা সমালোচনা। ১২তম সংশোধনী (১৯৯১): সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রবর্তন মূল বিষয়: প্রধানমন্ত্রীকে সরকারে প্রধান হিসাবে ঘোষনা করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে সীমিত করা হয়। বিস্তারিত প্রভাব: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার: ১৯৯১ সালের পর থেকে এটিই বাংলাদেশের মূল শাসনব্যবস্থা।প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি: সংসদ ভেঙে দেওয়া, মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।বিতর্ক: প্রধানমন্ত্রীর হাতে “অতিরিক্ত ক্ষমতা” হওয়ায় ভারসাম্যতার প্রশ্ন ওঠে। ১৩তম সংশোধনী (১৯৯৬): তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূল বিষয়: নির্বাচন পরিচালনার জন্য অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।বিস্তারিত প্রভাব:সুষ্ঠ নির্বাচন: ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়।২০১১ সালে বাতিল: ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে “অসাংবিধানিক” বলে বাতিল করেন।রাজনৈতিক সংকট: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি।বিতর্ক: বাতিলের ফলে “একদলীয় শাসনের পথ প্রশস্ত” হয়েছে বলে সমালোচনা হয় এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ১৪তম সংশোধনী (২০০৪): নারী আসন ৪৫-এ উন্নীত মূল বিষয়: সংসদে নারী আসন ৩০ থেকে ৪৫-এ উন্নীত করা।বিস্তারিত প্রভাব:প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি: নারীর উপস্থিতি ১৫%-এ পৌঁছায়, কিন্তু মনোনয়ন প্রক্রিয়াএকই ( কোটিা ভিত্তিক ) ।স্থানীয় সরকারের মডেল উপেক্ষিত: উপজেলা পর্যায়ে সরাসরি নির্বাচিত নারী নেতাদের অভিজ্ঞতা জাতীয় সংসদে কাজে লাগানো হয়নি।বিতর্ক: “মনোনীত নারী” হওয়ায় প্রকৃত ক্ষমতায়ন উপেক্ষিত । ১৫তম সংশোধনী (২০১১): তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল মূল বিষয়: নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল।বিস্তারিত প্রভাব: রাজনৈতিক অস্থিরতা: ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে আ. লীগ।আন্তর্জাতিক সমালোচনা: ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।বিতর্ক: গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করা হয়েছে – বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ। ১৬তম সংশোধনী (২০১৪): বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে মূল বিষয়: বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরত দেওয়া।বিস্তারিত প্রভাব:বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হ্রাস: এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের পথ তৈরি করে, যা বিচারিক স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে।সুপ্রিম কোর্টের রায় (২০১৭): আদালত এই সংশোধনীকে “অসাংবিধানিক” ঘোষণা করে এবং রায়ে উল্লেখ করে, “ক্ষমতার বিভাজন নীতির লঙ্ঘন হয়েছে”। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া:সরকারি দল এটিকে “জনগণের প্রতিনিধিত্বের অধিকার” বলে দাবি করলেও বিরোধী দল ও সুশীল সমাজ একে “গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক এবং হতাশাজনক” বলে সমালোচনা করে।বিতর্ক: “বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ” – সংবিধানের মূলনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ। ১৭তম সংশোধনী (২০১৮): সংসদে নারী আসন ৫০-এ উন্নীত মূল বিষয়: জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫
বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী : ইতিহাস ও বিশ্লেষণ এবং জনগণের প্রত্যাশা Read Post »