ainkhathon@gmail.com
Edit Template

বাংলাদেশে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা আইনের শ্লথ গতি ও সমাজের নিষ্ঠুর চেহারা।

বাংলাদেশে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা কোনো নতুন ঘটনা নয়। রাস্তার কুকুরকে পিটিয়ে মারা, বিড়ালছানাকে বিষ খাওয়ানো, গরুকে অনাহারে রেখে হাড়জিরজির করে তোলা—এসব দৃশ্য আমাদের চোখে এতটাই স্বাভাবিক যে, তা দেখেও আমরা আর চোখ ফেরাই না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নিষ্ঠুরতা কি আমাদেরই সমাজের অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক অধঃপতনের প্রতিচ্ছবি নয়?
২০১৯ সালে প্রণীত প্রাণী কল্যাণ আইন আশার আলো দেখালেও, বাস্তবে এর প্রয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। আইন আছে, শাস্তির বিধান আছে, কিন্তু নেই কার্যকর প্রয়োগ। প্রাণীদের আর্তনাদ যেন আইনের ফাঁক গলে হারিয়ে যায়। আজকে আমরা দেখবো, বাংলাদেশে প্রাণীদের বর্তমান অবস্থা, প্রাণী কল্যাণ আইন পাস হওয়ার পর থেকে কত মামলা হয়েছে, কতজন শাস্তি পেয়েছে এবং কেন এই আইন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রাণীদের বর্তমান অবস্থা: একটি করুণ চিত্র

বাংলাদেশে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা -র ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। কিছু পরিসংখ্যান ও উদাহরণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, আমরা কতটা পশুত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি:
১. রাস্তার কুকুর ও বিড়ালদের ওপর নির্যাতন
প্রতি বছর ৫০,০০০+ রাস্তার কুকুর বিষপ্রয়োগ, পিটিয়ে বা গাড়ি চাপায় মারা হয় (সূত্র: অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন)।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কিছু কর্মী -অবৈধভাবে কুকুর হত্যা করে, যদিও আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি কুকুরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ভিডিও ভাইরাল হয়, কিন্তু অপরাধী আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২. গৃহপালিত প্রাণীদের অবহেলা
– গরু, ছাগল ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীকে অনাহারে, রোদে-বৃষ্টিতে বেঁধে রাখা হয়।
অনেক গরুকে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে পঙ্গু বানানো হয়, কিন্তু মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৮% গৃহপালিত প্রাণী পর্যাপ্ত খাবার পায় না (ব্লু প্ল্যানেট রিপোর্ট)।
৩. বন্য প্রাণীদের ওপর অত্যাচার
-সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটন মৌসুম শেষ হলে বহু কুকুরকে ফেলে রাখা হয়, যারা অনাহারে মারা যায়।
বন থেকে ধরা পড়া বানর, গন্ধগোকুল বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীকে – বাজারে বিক্রি বা পিটিয়ে মারা হয়**।

২। প্রাণী কল্যাণ আইন, ২০১৯: আশা ও হতাশা
২০১৯ সালে **প্রাণী কল্যাণ আইন** পাস হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, এখন প্রাণীদের নির্যাতন বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

আইনের মূল ধারা ও শাস্তি

১. বিষপ্রয়োগে হত্যার শাস্তি (ধারা ৪(২): কোনো প্রাণীকে বিষ বা অন্য কোনো নৃশংস পদ্ধতিতে হত্যা করলে, দণ্ডবিধির ৪২৮ ও ৪২৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তি- ২ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড
২. সাধারণ নিষ্ঠুরতার শাস্তি (ধারা ৪(১) প্রাণীকে অকারণে আঘাত করা, ক্ষতি করা বা যন্ত্রণা দেওয়া- ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১০,০০০ টাকা জরিমানা
দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ
৩. অবহেলা ও উপেক্ষার শাস্তি (ধারা ৫)
: প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি, আশ্রয় না দেওয়া, অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসা না করানো, ৩ মাস কারাদণ্ড বা ৫,০০০ টাকা জরিমানা।

আইন পাসের পর কত মামলা হয়েছে?

২০২০-২০২৩ পর্যন্ত মোট ১৫৭টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে (সূত্র: বাংলাদেশ পুলিশ)।
এর মধ্যে মাত্র ২৩টি মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে। বাকি মামলাগুলো -অনুসন্ধান বা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।

প্রানী কল্যান আইন ২০১৯ হওয়ার পর মামলা শাস্তির পরিসংখ্যান (২০২০২০২৪)

বছরমামলাশাস্তিবিচারাধীন
২০২০২২টি০৩ জন১৯ টি
২০২১৩৫টি০৫ জন৩০টি
২০২২৪৮টি০৭ জন৪১টি
২০২৩৫২ টি০৮ জন৪৪ টি

সূত্র: বাংলাদেশ পুলিশ ও অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন

৩। কেন এই আইন কার্যকর হচ্ছে নাঃ

১.পুলিশের অসচেতনতা: ৭০% থানায় এই আইন সম্পর্কে ধারণা নেই (AWF সার্ভে, ২০২৩) মামলা নিতে অনীহা দেখা যায়, কারণ প্রাণী নির্যাতনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
২. পমাণ সংগ্রহে সমস্যা: নির্যাতনের ভিডিও বা সাক্ষী না থাকলে মামলা টেকে না। অনেক সময় **স্থানীয় প্রভাবশালীরা চাপ প্রয়োগ করে মামলা তুলে নেয়।
৩. মামলা নিষ্পত্তির ধীর গতি: একটি মামলার নিষ্পত্তি হতে ২-৪ বছর লেগে যায়। ভুক্তভোগী (প্রাণী) আদালতে উপস্থিত হতে পারে না, তাই মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে।।
৪. সামাজিক স্বীকৃতির অভাব: সমাজের অনেকেই মনে করেন, “প্রাণীর জন্য এত ঝামেলা কেন?”  প্রাণী অধিকার কর্মীদের হেয়প্রতিপন্ন করা হয়।

 উল্লেখযোগ্য মামলা ও কেস স্টাডি

১. ২০২১: ঢাকায় কুকুরের উপর অ্যাসিড নিক্ষেপঃ একটি রাস্তার কুকুরের উপর অ্যাসিড ছুড়ে মারার ঘটনায় মামলা হয়। অপরাধী ২ বছর পর শাস্তি পায় (প্রথমবারের মতো এই আইনে শাস্তি)।
২. ২০২২: সাভারে গরু পিটিয়ে হত্যাঃ একটি গরুকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হলে মামলা হয়। মালিক জরিমানা ও ৬ মাস কারাদণ্ড পান ।
৩. ২০২৩: কক্সবাজারে বানর পিটিয়ে মারাঃ  একটি বানরকে পর্যটকরা পিটিয়ে মারলে স্থানীয়রা মামলা করে। মামলাটি এখনও বিচারাধীন।

৪। কীভাবে এই অবস্থা বদলানো সম্ভবঃ

১. আইনের কঠোর প্রয়োগঃ পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রাণী কল্যাণ আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রতিটি থানায় প্রাণী নির্যাতন বিষয়ক বিশেষ সেল গঠন করা উচিত।
২. প্রমাণ সংগ্রহে সহায়তাঃ নির্যাতনের ভিডিও বা ছবি থাকলে মামলা শক্তিশালী হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায় (যেমন: ২০২৩ সালে খুলনায় একটি কুকুরকে পিটিয়ে মারার ভিডিও ভাইরাল হলে দোষীকে আটক করা হয়)।
৩. সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোঃ  স্কুল-কলেজে প্রাণী অধিকার বিষয়ক কর্মশালা করা যেতে পারে। মসজিদ, মন্দির ও গণমাধ্যমে  প্রাণীদের প্রতি দয়াশীল হওয়ার বার্তা প্রচার করতে হবে।

৪. প্রাণী কল্যাণ সংগঠনগুলোর শক্তিশালীকরণ অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, ব্লু প্ল্যানেট. প ফাউন্ডেশন  ইত্যাদি সংগঠনগুলোকে সরকারি সহায়তা দেওয়া উচিত। একটি জাতীয় প্রাণী হেল্পলাইন নম্বর চালু করা দরকার।

আমরা কি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছিঃ
একটি দেশের নৈতিক অবস্থান বোঝা যায় সেখানকার প্রাণীদের প্রতি মানুষের আচরণ দেখে। বাংলাদেশে প্রাণী নির্যাতনের ঘটনাগুলো শুধু আইনের ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের সামষ্টিক নৈতিক অবক্ষয়েরপরিচয়। “প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা কোনো সভ্য সমাজের পরিচয় হতে পারে না।”- মহাত্মা গান্ধী
আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই মানুষ সচেতন, কিন্তু কণ্ঠস্বর নেই। আমরা কুকুর-বিড়ালের যন্ত্রণায় কান ঢেকে দিই, কারণ “এগুলো তো শুধু প্রাণী“। কিন্তু ভুলে যাই, যে সমাজ প্রাণীর কষ্টকে উপেক্ষা করে, সে সমাজ একদিন মানুষের কষ্টকেও উপেক্ষা করবে। Leonardo da Vinci বলেছেন- যে দিন মানুষ প্রানীদের হত্যা করা বন্ধ করবে, সেদিন মানুষও একে অপরকে হত্যা করা বন্ধ করবে।

আসুন, প্রাণীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাই। প্রানীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করুন একটি কুকুরকে খাবার দিন, একটি বিড়ালকে রাস্তা পার করে দিন, একটি গরুকে পানি পান করতে সাহায্য করুন। ক্ষুদ্র এই ভালোবাসাই আমাদের মানুষ করে তোলে।

রেফারেন্স
১. প্রাণী কল্যাণ আইন, ২০১৯ – বাংলাদেশ গেজেট
২. অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (AWF) – প্রাণী নির্যাতন রিপোর্ট (২০২৩)।
৩. বাংলাদেশ পুলিশ – মামলা সংক্রান্ত ডেটা (২০২৪)।
৪. ব্লু প্ল্যানেট – গৃহপালিত প্রাণী গবেষণা (২০২৩)।
৫. প্রথম আলো – ঢাকায় কুকুর অ্যাসিড নিক্ষেপ কেস (২০২১)।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Impact Financial

Good draw knew bred ham busy his hour. Ask agreed answer rather joy nature admire wisdom.

Latest Posts

  • All Posts
  • আইনগত পরামর্শ
  • আদালত সংক্রান্ত সেবা
  • আন্তর্জাতিক আইন
  • ই-বুক
  • কেস লিস্ট এস সি
  • গ্যালারি
  • গ্যালারি_১
  • জন সচেতনতা
  • ব্লগ
    •   Back
    • ফৌজদারি আইন
    • দেওয়ানী
    • ইনকাম টেক্স
    • ভোক্তা অধিকার
    • পারিবারিক

Categories

Tags

আমাদের সকল আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

You have been successfully Subscribed! Ops! Something went wrong, please try again.

আইন, অধিকার ও আইনী পরামর্শ।

আমাদের সম্পর্কে

কপিরাইট নোটিস

ট্রেড লাইসেন্স নংঃ ২৪০০৮৮২৫০১৯০০৭৩৮৯

ডিবিআইডি: ২৮৮৬৬৬৪৬০

গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক

যোগাযোগ করুন

আমাদের ফলো করুন:

আইনকথন.কম © ২০২৪ ডেভেলপার আতিকুর রহমান

Scroll to Top